সমাজবিজ্ঞানে এমিল ডুর্খীম এবং অগাস্ট কোঁৎ এর অবদান

সমাজতত্ত্বে এমিল ডুর্খীম এবং অগাস্ট কোঁৎ এর অবদান (Contributions of August Comte and Emil Durkheim to sociology): ফরাসী সমাজবিজ্ঞানী অগাস্ট কোঁৎ ১৮৩৯ সালে সর্বপ্রথম Sociology শব্দটি ব্যবহার করেন। তাকে সমাজবিজ্ঞানের জনক বলা হয়।

এল. এফ. ওয়ার্ডের মতে, “সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে সমাজ সম্পর্কিত একটি বিজ্ঞান, যেখানে সামাজিক প্রপঞ্চসমূহ পাঠ করা হয়।” এমিল ডুর্খেমের মতে সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞান।

সমাজতত্ত্বে এমিল ডুর্খীম এবং অগাস্ট কোঁৎ এর অবদান অবদান আলোচনা করা হলঃ

অগাস্ট কোঁৎ (১৭৯৮-১৮৫৭):
August Comte img src: socialicous.wordpress.com

১৭৯৮ সালের ১৯ জানুয়ারি ফ্রান্সের মন্টপেলিয়ারে অগাস্ট কোঁৎ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পড়াশোনা করেন প্যারিসের Ecole Polytechnic এ। ১৮৩২ সালে তিনি তাঁর বিখ্যাত ছয় খন্ডের The Positive Philosophy বই রচনা করেন। System of Positive polity তার অপর গ্রন্থ। ১৮৫৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বিজ্ঞান সম্পর্কে অগাস্ট কোঁৎ এর ধারণা দ্বন্দ্ববাদ বিরোধী ছিল। অধিবিদ্যা সূচক চিন্তা তিনি উনিশ শতকের তৃতীয় দশকে প্রকাশ করেন। অগাস্ট কোঁৎ এর দৃষ্টবাদী পদ্ধতি আধ্যাত্মিকবাদের বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করে। কোঁৎ প্রদত্ত বিজ্ঞানে বিচিত্র প্রবণতা বিদ্যমান। অগাস্ট কোৎ সমাজবিজ্ঞান পাঠে পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক পদ্ধতি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।

প্রকারভেদঃ

সমাজবিজ্ঞানের জনক অগাস্ট কোঁৎ সমাজবিজ্ঞানকে দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করেছেন। সামাজিক স্থিতিবিদ্যা এবং সামাজিক গতিবিদ্যা। সামাজিক স্থিতিবিদ্যা অস্তিত্বের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এবং সমাজ ব্যবস্থার কার্যকারিতার সূত্র অনুধাবন করার প্রয়াস পায়। সামাজিক স্থিতিবিদ্যা হচ্ছে সমাজব্যবস্থা, সংগঠন এবং সমন্বয় সাধনের একটি তত্ত্ব। সামাজিক গতিবিদ্যা সমাজব্যবস্থার বিকাশ এবং পরিবর্তনের সূত্র নির্ণয়ে নিয়োজিত থাকে। কোৎ স্থিতিবিদ্যার দিক দিয়ে সমাজকে একটি জৈবিক সামগ্রিক সত্তা হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

সমাজবিজ্ঞান বিষয়টির উৎপত্তি হয় ১৮৩৯ সালে

তিনি পরিবার, রাষ্ট্র, ধর্ম ইত্যাদি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা এবং কার্যকারিতার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। কোৎ এর মতে পরিবার হচ্ছে নৈতিক প্রতিষ্ঠান, যার ভিত্তিমূলে রয়েছে পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক সহমর্মিতা। তিনি পিতৃতান্ত্রিক  পরিবার ব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন। তবে সন্তানসন্ততি পালনে নারীর ভূমিকাও তিনি স্বীকার করেছেন। (অগাস্ট কোঁৎ এর অবদান)

সমাজবিজ্ঞানের জনক অগাস্ট কোঁৎ. সর্বপ্রথম তিনি এ বিষয়ের নাম দেন ‘social physics’.

সমাজবিজ্ঞানী অগাস্ট কোঁৎ সমাজবিজ্ঞানকে একটি দৃষ্টবাদী বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করেছেন। দৃষ্টবাদী বিজ্ঞান হলো দার্শনিক তত্ত্ব যা নির্দিষ্ট জ্ঞান প্রাকৃতিক ঘটনা এবং তাদের বৈশিষ্ট্য এবং সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে বর্ণনা করে। তিনি মনে করেন মানুষের জীবনের গতিশীলতা পাঠে দৃষ্টবাদী তত্ত্ব অপরিহার্য। সমাজ বিকাশে যে সব উপাদান নির্ধারক কোৎ সে সবকে দুইভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমনঃ মূখ্য ও গৌণ। আধ্যাত্মিক ও মানসিক বিকাশ হচ্ছে মূখ্য নির্ধারক এবং জলবায়ু, বর্ণ, জনসংখ্যা, বৃদ্ধি ইত্যাদিকে তিনি গৌণ উপাদান হিসেবে গণ্য করেন। সমাজ প্রগতিকে বস্তুগত, প্রকৃতিগত, বুদ্ধিগত এবং নৈতিক এই চারভাগে ভাগ করেন। (অগাস্ট কোঁৎ এর অবদান) 

সামাজিক স্তরবিন্যাস কী? স্তরবিন্যাসের বিশ্বজনীন ধরন।

দার্শনিক ব্যবস্থাঃ

অগাস্ট কোঁৎ মানব মনের যুক্তির বিকাশের প্রেক্ষিতে তিনটি দার্শনিক ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করেন। যেমনঃ- ধর্মকেন্দ্রিক, অধিবিদ্যা ভিত্তিক এবং দৃষ্টবাদী

তাঁর এই ত্রিস্তর তত্ত্ব সামাজিক গতিবিদ্যার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। অগাস্ট কোত ধর্মকেন্দ্রিক চিন্তার স্তরকে প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত তিনভাগে ভাগ করেছেন। যেমনঃ- বস্তুভক্তিবাদ, বহু ঈশ্বরবাদ, একেশ্বরবাদ। বস্তু ভক্তিবাদের যুগে মানুষ বাহ্যিক বস্তুর মধ্যে জীবনের অস্তিত্বে বিশ্বাস করত এবং বস্তুর মাঝেই ঈশ্বর আছেন বলে ধারণা করা হত। প্রাচীন গ্রিস এবং রোমান সভ্যতার যুগে বস্তুগত সংস্কৃতির দুর্বল বিকাশের জন্য বহু ঈশ্বরবাদের অস্তিত্ব দেখা যায়। খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একেশ্বরবাদের যুগ সূচিত হয়। (অগাস্ট কোঁৎ এর অবদান)

অধিবিদ্যা চিন্তার যুগ (১৩০০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ) হচ্ছে ক্রান্তিকালীন পর্যায়। এ স্তরে এসে প্রাচীন ধ্যানধারণা, বিশ্বাস ও সমাজব্যবস্থার ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। ধর্মসংস্কার আন্দোলন, প্রজ্ঞাবাদ এই যুগের বৈশিষ্ট্য।

অন্যদিকে বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং তার সামাজিক তাৎপর্য, স্বার্থপরতার বিপরীতে পরার্থপরতার বিজয়, সামাজিক অনুভূতির বিকাশ, বস্তুগত সংস্কৃতির দ্রুত সম্প্রসারণ দৃষ্টবাদী স্তরের প্রধান বৈশিষ্ট্য। দৃষ্টবাদী তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার ফলে সমাজ সমীক্ষার দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন, শ্রমশিল্প ব্যবস্থা সামন্ততান্ত্রিক সামরিক ব্যবস্থার স্থলাভিষিক্ত হয়।

এমিল ডুর্খীম (১৮৫৮-১৯১৭):
Emil Durkheim img src: commons.wikimedia.org

১৮৫৮ সালে ফ্রান্সে এমিল ডুর্খেম জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কর্মজীবনে ফ্রান্সের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানের কোর্স পড়াতেন। ডুর্খেম যেসব মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশ করেন সেসব সমাজবিজ্ঞানে মূল্যবান অবদান হিসেবে স্বীকৃত।(অগাস্ট কোঁৎ এর অবদান)

The Division of Labor in society, The Rules of Sociological Method, Sociology of Education, Moral Education তার রচিত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।

ডুর্খেমের সমাজতাত্ত্বিক চিন্তা ও শিক্ষার তত্ত্বগত ও আদর্শগত ভিন্নতা ছিল ফরাসী প্রজ্ঞাবাদী দার্শনিকের মতাদর্শ। তিনি ফরাসী দার্শনিক মন্টেস্কু, কঁদরচে এবং রুশোর ধ্যানধারণার দ্বারা প্রভাবিত হন। ডুর্খেমের মতে সমাজবিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য হলো সামাজিক ঘটনার অনুধাবন। তিনি এমন একটি বুর্জোয়া মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যার থাকবে বৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্য। শ্রম ও পুঁজির মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসনে উদ্যোগী হন।

সামাজিক সংহতিঃ

ডুর্খেইম সামাজিক সংহতির ধারণা প্রদান করেন। সামাজিক সংহতি দুই প্রকার। ১) যান্ত্রিক সংহতি এবং ২) জৈবিক সংহতি। তিনি অবিকশিত আদিম প্রাচীন সমাজে বিদ্যমান সংহতিকে যান্ত্রিক সংহতি এবং আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে বিদ্যমান সংহতিকে বলেছেন জৈবিক সংহতি। তিনি বলেন সামাজিক সংহতি সমাজের সম্মিলিত চেতনাতে পাওয়া যায়। ডুর্খেম সামাজিক সংহতির ধারণাকে দৃষ্টবাদ থেকে পুঁজিবাদী স্লোগানে পরিণত করেছিলেন।

সমাজতন্ত্রে প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির তিনটি বৈশিষ্ট্য ছিল। যেমনঃ- ১) অপৃথকীকরণ, ২) সেন্ট সাইমন প্রবর্তিত সমাজতন্ত্রের প্রতি সহানুভূতি, ৩) মার্কস প্রবর্তিত শ্রেণি তাৎপর্য উপলব্ধির প্রতি অনীহা। প্রকৃতপক্ষে ডুর্খেইম শ্রেণী সংগ্রামের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন না।

ডুর্খেমের সমাজবিজ্ঞানে সামাজিক সমস্যা হিসেবে আত্মহত্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানে সমাজবিজ্ঞানের নীতিমালা প্রয়োগ করার প্রয়াস পান। তিনি চার ধরনের আত্মহত্যা সনাক্ত করেছেন। যেমনঃ- আত্মকেন্দ্রিক, পরার্থপর, নৈরাজ্যমূলক এবং অদৃষ্টবাদী। (অগাস্ট কোঁৎ এর অবদান)

আত্মহত্যাঃ

আত্মকেন্দ্রীক আত্মহত্যার কারণ হিসেবে ডুর্খেম ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা, ব্যক্তির উপর সমাজের সীমাহীন প্রভাব, সামাজিক বন্ধনের শৈথিল্য, একাকীত্ববোধ এবং বিষন্নতাকে চিহ্নিত করেন। মানুষ যখন নিজেকে সমাজ থেকে আলাদা এবং সমাজে তার জায়গা নেই ভাবে তখন সে নিজেকে হত্যা করে।

পরার্থপর আত্মহত্যা ঘটে যখন ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে সমাজের সামগ্রিক স্বার্থ এবং গোষ্ঠী সংহতি প্রবল হয়ে উঠে। অন্যজনের স্বার্থ, গোষ্ঠী বা সমাজের স্বার্থে পরার্থপর আত্মহত্যা ঘটে। যেমনঃ- যুদ্ধচলাকালীন সময়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আত্মহত্যা, নৈতিক মূল্যবোধ রক্ষা কর‍তে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা, বৃদ্ধ ও অসুস্থ লোকের আত্মহত্যা, স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর স্বেচ্ছামৃত্যু ইত্যাদি। (অগাস্ট কোঁৎ এর অবদান)

সমাজে উত্থানপতন এবং অর্থনৈতিক সংকট বৃদ্ধি পেলে নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এ পরিস্থিতিতে ব্যক্তি সমাজের পরিবর্তনের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা হারায়, পরিবর্তিত সমাজে নিজেকে বেমানান মনে করে।

অদৃষ্টবাদী আত্মহত্যা হচ্ছে নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যার ভিন্নরূপ, যার মূলে আছে ব্যক্তির উপর গোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান প্রভাব, মাত্রাতিরিক্ত কঠোর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, যা ব্যক্তির কাছে অসহনীয়। ব্যক্তির ভবিষ্যৎ চরম অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হলে এবং তার অনুভূতি নির্যাতনমূলক আইন দ্বারা নিপীড়িত হলে অদৃষ্টবাদী আত্মহত্যা ঘটে। (অগাস্ট কোঁৎ এর অবদান)

 

উত্তরঃ ১৮৩৯ সালে
  • বাংলাদেশের সমাজ বিজ্ঞানের জনক কে?
বাংলাদেশের সমাজ গবেষণায় এবং সমাজবিজ্ঞান শিক্ষা বিকাশের ক্ষেত্রে অধ্যাপক ড. নাজমুল করিম পথিকৃৎ হিসেবে অগ্রগণ্য।
  • অগাস্ট কোঁৎ সর্বপ্রথম কত সালে Sociology শব্দটি ব্যবহার করেন?
ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট কোঁৎ ১৮৩৯ সালে তার ‘পজেটিভ ফিলোসফি’ গ্রন্থের ৪র্থ খন্ডে প্রথম Sociology (সমাজবিজ্ঞান) শব্দটি ব্যবহার করেন
  • সামাজিক গতিশীলতা বলতে কি বুঝায়?
উত্তর : এক স্তর থেকে অন্য স্তরে ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা বা অবস্থানের পরিবর্তনই হলো সামাজিক গতিশীলতা
  • সামাজিক গতিশীলতা কে কয় ভাগে ভাগ করা যায়?
উত্তর : সামাজিক গতিশীলতাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা— (i) আনুভূমিক (ii) উলম্ব গতিশীলতা
  • সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি কি?
সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি : কোনো বিষয় বা বস্তুর প্রকৃতি বলতে ওই বিষয় বা বৈশিষ্ট্য বা স্বভাব বা পরিচয়কে বোঝায়। অতএব সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি বলতে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের বৈশিষ্ট্য বা পরিচয়কে বোঝায়। সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য, স্বভাব নিচে আলোচনা করা হলো। (অগাস্ট কোঁৎ এর অবদান)

3 thoughts on “সমাজবিজ্ঞানে এমিল ডুর্খীম এবং অগাস্ট কোঁৎ এর অবদান”

Leave a Comment

Exit mobile version