পোল্যান্ড বিভাজন : পটভূমি, বিভাজনের ধাপ এবং ফলাফল

পোল্যান্ড অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ ছিল। শুধুমাত্র রাশিয়া এবং সুইডেন পোল্যান্ডের চেয়ে বড় ছিল। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে পোল্যান্ড ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলে। ফলে তার রাজনৈতিক অস্তিত্ব বিনষ্ট হয়। প্রাশিয়া, রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়া পোল্যান্ডকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। ফলে ইউরোপের মানচিত্র থেকে পোল্যান্ড এর অস্তিত্ব মুছে যায়।

পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের পটভূমি: 

চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত জাগেলো রাজবংশ পোল্যান্ড শাসন করতো। 1570 সালে জাগেলো রাজবংশ উচ্ছেদ হলে পোল্যান্ডের রাজপদে অভিজাতরা তাদের মনোনীত প্রার্থীকে বসানোর চেষ্টা করতেন। পোল্যান্ডের শক্তিশালী অভিজাত শ্রেণীর প্রভাবে পোল্যান্ডে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাদের দুর্নীতির কারণে শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ডায়েট নামক কেন্দ্রীয় আইন সভায় অভিজাতদের একচেটিয়া স্থান ছিল। ফলে ডায়েটে আইন পাস সহজ ছিল না। কারণ সপ্তদশ শতকে ‘লিভেরাম ভেটু‘ দ্বারা যে কোন সদস্যই পরিষদের কার্যাবলী কে বাতিল করতে পারত। এই সুযোগে পোল্যান্ডের প্রতিবেশী রাষ্ট্র সমূহ নীতিহীন পন্থায় নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন করে।

পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ বা বিভাজন এর কারণ:

পোল্যান্ড লিথুয়ানিয়া ১৩৮৫-১৫৭২

রাজতন্ত্রের দুর্বলতা: 

পোল্যান্ডের দুর্বল রাজতন্ত্রের কারণে পোল্যান্ডের শাসন তন্ত্র অনুযায়ী ডায়েট সভার মাধ্যমে রাজা নির্বাচিত হতেন। প্রশাসনে রাজার কোন নিয়ন্ত্রন ছিল না। রাজার হারানোর ক্ষমতা অভিজাতরা একক ভাবে অর্জন করে নেয়। আইন প্রণয়ন ক্ষমতা, যুদ্ধ ঘোষণা করা, কর ধার্য করার ক্ষমতা অভিজাতদের মধ্যেই নিহিত ছিল। পোল্যান্ড রাজা জন সোবিয়েস্কি’র মৃত্যুর পর পোল্যান্ডের রাজতন্ত্র একেবারে দুর্বল হয়ে যায়।

অভিজাত শ্রেণীর স্বার্থপরতা: 

পোল্যান্ডের অভিজাতরা নিজেদের ইচ্ছামত কর দিতো। রাজনীতি এবং চার্চে তাদের একচেটিয়া অধিকার ছিল। তারা রাজনৈতিকভাবেও একতাবদ্ধ ছিল। অভিজাতরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিদেশিদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে দেশের ক্ষতি করতে কুণ্ঠাবোধ করত না। শহরের জনসংখ্যার অর্ধেক ইহুদি বা বিদেশি ছিল। স্থানীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অস্থিত্ব না থাকায় তারা অপ্রতিহত ভাবে নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করত। ভূমিদাসরা অভিজাত কর্তৃক নির্যাতিত হত।

ধর্মীয় অনৈক্য: 

তৎকালীন পোল্যান্ডে কোনরকম ধর্মীয় সম্প্রীতি ও ঐক্য ছিল না। জনগণ ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট দুই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। সংখ্যালঘু ক্যাথলিকরা দেশ পরিচালনা করত এবং প্রোটেস্ট্যান্টদের অত্যাচার করত।

রেনেসাঁ কী? রেনেসাঁর বৈশিষ্ট্য বা প্রভাব সমূহ আলোচনা কর।

ভৌগলিক অনৈক্য: পোল্যান্ড তিনটি পৃথক এলাকায় বিভক্ত ছিল। যা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় ছিল। তাছাড়া পোল্যান্ডের কোন স্বাভাবিক সীমারেখা ছিল না। ফলে বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করার ব্যাপারে তারা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

অর্থনৈতিক সংকট: পোলিশদের (পোল্যান্ডের জনগণ) অর্থনৈতিক সংকট পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ বা বিভাজন এর অন্যতম কারণ ছিল। আভ্যন্তরীণ শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতার জন্য উত্তর ইউরোপে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে সুইডেনের উত্থান পোল্যান্ডের বাণিজ্যিক প্রাধান্য নষ্ট করে। ফলে অর্থাভাবে তারা শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তুলতে পারেনি।

উত্তরাধিকার সংক্রান্ত গোলযোগ: পোল্যান্ড এর আভ্যন্তরীণ বিশৃংখলা যখন চরমে পৌঁছে তখন 1663 সালে তৃতীয় অগাস্টাসের মৃত্যু হলে পরবর্তী রাজা কে হবেন তা নিয়ে বিরোধী শক্তি গুলোর মধ্যে গোলযোগ সৃষ্টি হয়।

ইংল্যান্ড ফ্রান্সের হস্তক্ষেপ না করা: চলমান পোল্যান্ড সংকটে ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী দেশ ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স কোন ভূমিকা রাখেনি। দেশ দুটি রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য পক্ষপাতি ছিল এবং আমেরিকার সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত ছিল।

পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ বা পোল্যান্ড বিভাজন এর পূর্ব পরিকল্পনা: 

পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগে ইউরোপের প্রাশিয়া (বর্তমান নাম জার্মানি), রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়া পোল্যান্ড বিভাজন এর পরিকল্পনা করে। তবে 1573 সালে পবিত্র রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ম্যাক্সিমিলিয়ান প্রথম পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ এর প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। এরপর প্রায় এক শতাব্দী পরে সুইডেনের রাজা দশম চার্লস পুনরায় এ প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তিনি প্রাশিয়ার গ্রেট ইলেক্টরের সাথে এক গোপন চুক্তি দ্বারা ব্রান্ডেনবার্গ (বর্তমান নাম জার্মানি) ও সুইডেনের মধ্যে পড়েন ভাগ করে নেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। রাশিয়ার পিটার দ্য গ্রেট ও পোল্যান্ড বিভাজনের কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ওই সকল পরিকল্পনা কার্যকরী হয়ে উঠেনি। পরিশেষে 1772 সালে প্রাশিয়ার সম্রাট ফ্রেডারিক এর উদ্যোগে রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ক্যাথারিন ও অস্ট্রিয়ার সম্রাজ্ঞী মেরিয়া তেরেসা প্রথম পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

পোল্যান্ড বিভাজন পটভূমি, বিভাজনের ধাপ এবং ফলাফল
পোল্যান্ডের প্রথম ব্যবচ্ছেদ বা বিভাজন:

প্রাশিয়া – পশ্চিম প্রাশিয়া, পূর্ব পোল্যান্ডের কিছু অংশ।
রাশিয়া – হোয়াইট রাশিয়া, ডুইনা ও নিপার নদীর মধ্যবর্তী স্থান সমূহ।
অস্ট্রিয়া – রেড রাশিয়ার অধিকাংশ, গ্যালিসিয়া, স্যান্ডোসির এবং ক্র্যাকো দখল করে।

এ বিভাজন এর ফলে পোল্যান্ড এক-তৃতীয়াংশ রাজ্যের প্রায় অর্ধেক বাসিন্দা হারায়। প্রাশিয়া পশ্চিম প্রাশিয়া দখল করায় ব্রান্ডেনবার্গ ও পূর্ব প্রাশিয়ার রাজ্যাংশ দু’টি ঐক্য লাভ করে। সুতরাং এ বিভাজন এর ফলে সর্বাধিক লাভবান হয় প্রাশিয়া।

পোল্যান্ডের দ্বিতীয় ব্যবচ্ছেদ বা বিভাজন: 

1783 সালে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে পোল্যান্ডের জনগণ রাশিয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। তারা প্রাশিয়ার সাথে সন্ধি করে দেশের শাসনতন্ত্রের সংস্কার করে নির্বাচন এর পরিবর্তে উত্তরাধিকারসূত্রে রাজতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। ‘লিভেরাম ভেটো’ উচ্ছেদ করে রাষ্ট্র ধর্ম ক্যাথলিক করা হয় এবং অন্য ধর্মালম্বীদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়া হয়। অস্ট্রিয়ার রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড এ সংস্কারের সমর্থন দান করেন কিন্তু রাশিয়া ক্ষুব্ধ হয় এবং প্রাশিয়া শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ পোল্যান্ডের উত্থানে বিচলিত হয়।

রুশ – তুর্কি যুদ্ধ শেষ হলে রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ক্যাথারিন 1792 সালে 80,000 নিয়মিত সেনা ও 2,000 কোসাক সেনা নিয়ে পোল্যান্ড আক্রমণ করেন এবং রাশিয়ার সৈন্যদল পোল্যান্ডের কতিপয় অভিজাতদের সহায়তায় পোল্যান্ড বাহিনীকে পরাজিত করে। এদিকে অস্ট্রিয়ার রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড মৃত্যুবরণ করলে পোল্যান্ড বৈদেশিক সামরিক সহায়তা লাভে ব্যর্থ হয়। এ অবস্থায় পোল্যান্ডের রাজা স্ট্যানিসলাস পোল্যান্ডের সমগ্র সংস্কার বাতিল করেন। অন্যদিকে প্রাশিয়া, রাশিয়ার সাথে গোপন চুক্তি করে পোল্যান্ড বিভাজন বা পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের ব্যবস্থা করে। চুক্তি মোতাবেক-

প্রাশিয়া – ডানজিগ, থর্ন, পোজেন, লেজেন, কেনিস্ক দখল করে।
রাশিয়া – পূর্ব পোল্যান্ড, লিটল রাশিয়া, মিঙ্খস,পোডোলিয়ার বাকী অংশ।
অস্ট্রিয়া – দূরবর্তী নেদারল্যান্ডস এর পরিবর্তে ব্যাভেরিয়া দখল করার জন্য প্রাশিয়া ও রাশিয়ার সমর্থন পাবে, এ প্রতিশ্রুতি পায়।

পোল্যান্ড এর তৃতীয় ব্যবচ্ছেদ: 

পোল্যান্ডের যেটুকু স্থান তখনো পোল্যান্ড নামে পরিচিত ছিল তার স্বাধীনতার জন্য পোল্যান্ডের কতিপয় দেশ প্রেমিক কোসিয়াস্কোর নেতৃত্বে 1794 সালে এক বিদ্রোহ দেখা দেয়। রাশিয়ার সৈন্য দ্রূত পোল্যান্ডে উপস্থিত হয়ে এই বিদ্রোহ দমন করেন এবং তৃতীয় পোল্যান্ড বিভাজন বা পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ আরম্ভ হয়। চুক্তি অনুযায়ী-

প্রাশিয়া – পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশো এবং পার্শ্ববর্তী স্থানসমূহ দখল করে।
রাশিয়া – গ্যালিসিয়া এবং ডুইনা নদীর মধ্যবর্তী স্থান সমূহ লাভ করে।
অস্ট্রিয়া – গ্যালিসিয়া এবং ক্র্যাকোর যে সকল অংশ প্রথম ব্যবচ্ছেদের সময় পায়নি সে সকল দখল করে।

ফলে ইউরোপের মানচিত্র থেকে স্বাধীন পোল্যান্ড রাজ্য টি সম্পূর্ণভাবে মুছে যায়।

পোল্যান্ড বিভাজন এর ফলাফল: 

প্রাথমিকভাবে পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ ইউরোপের রাজনীতিতে প্রাশিয়াকে শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ দেয়। প্রাশিয়ার জনবহুল অংশে তাদের সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখে। প্রাশিয়া পরবর্তীতে জার্মানিতে রূপান্তরিত হয়। রাশিয়ার পক্ষে পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ লাভজনক হয়নি। তার উচিত ছিল পোল্যান্ডকে নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখা কিন্তু বাক করার ফলে রাশিয়ার শত্রুদেশ প্রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়ার শক্তি বৃদ্ধি পায়। রুশ সম্রাজ্ঞী ২য় ক্যাথারিন এখানে কূটনৈতিক অদূরদর্শিতার পরিচয় দেন। অস্ট্রিয়ার দিক থেকেও পোল্যান্ড বিভাজন তেমন লাভজনক হয়নি। পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের কারণে পর রাজ্য হরণের যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় তা পরিবর্তিতে নেপোলিয়ন এবং হিটলার পুনরাবৃত্তি করেন।

1 thought on “পোল্যান্ড বিভাজন : পটভূমি, বিভাজনের ধাপ এবং ফলাফল”

Leave a Comment

Exit mobile version