ধর্মের সংজ্ঞা । ধর্ম সামাজিকীকরণের অন্যতম বাহন (উপাদান 4 টি)

ধর্মের সংজ্ঞা

এমিল ডুর্খীম এর মতে, “ধর্ম হলো পবিত্র বস্তু সম্পর্কিত বিশ্বাস ও আচারানুষ্ঠানের একটি একীভূত ব্যবস্থা। আর যার পৃথকীকৃত বস্তুর সাথে রয়েছে বাধা নিষেধের সম্পর্ক।”

এডওয়ার্ড সেপির এর মতে,”ধর্ম হচ্ছে আধ্যাত্মিক শান্তি অন্বেষার একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস, যার মাধ্যমে প্রাত্যহিক জীবনের বিপদ-আপদ ও বিফলতা অতিক্রম করা সম্ভব।”

দার্শনিক ইকবাল ধর্মের সংজ্ঞায় বলেন, “ধর্ম বিভাগীয় ব্যাপার নয়, এ নিছক চিন্তন নয় কিংবা নিছক অনুভুতি নয় কিংবা নিছক ক্রিয়াও নয়- এ হলো মানুষের সামগ্রিক প্রকাশ।”

সমাজবিজ্ঞানীরা ধর্মকে অন্যতম সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিকীকরণের অন্যতম বাহন হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

ধর্মের উপাদান চারটি। অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস, অতিপ্রাকৃত সত্তার সাথে মানুষের উপযোজন, পাপ সম্পর্কিত ধারণা, মুক্তির পদ্ধতি।

ধর্মের সামাজিক ভূমিকাঃ 

সমাজবিজ্ঞানীরা ধর্মের ভূমিকাকে আট ভাগে ভাগ করেছেন। ধর্মের সংজ্ঞা 

১। মানুষের ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্টের ব্যাখ্যাদানঃ মানুষ অনুভূতিপ্রবণ প্রাণী হওয়ায় শুধু জ্ঞানের উপর ভরসা করে বাঁচতে পারেনা। ধর্ম মানুষের দুঃখ-কষ্টকে সহনীয় মাত্রায় রাখতে সাহায্য করে। মানুষ যখন তার প্রত্যাশিত কোন কিছু পেতে ব্যর্থ হয় তখন সে সান্ত্বনা লাভের জন্য ধর্মের শরণাপন্ন হয়। ধর্মীয় অনুভূতির প্রভাবে সে তার দুর্ভাগ্যকে মেনে নেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কারো নিকটাত্মীয় মারে গেলে ব্যক্তি নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেয়, ঈশ্বর যেটা ভালো মনে করেছেন সেটাই করেছেন। এভাবে মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাসের বলে মানুষ নিজেকে ভেঙ্গে পড়া থেকে রক্ষা করে।

২। মানুষের নিজের গুরুত্ব বৃদ্ধিঃ  মানুষ ঈশ্বরের সান্নিধ্য পেতে চায়। ধর্ম বিশ্বাসীদের কাছে আত্মার অর্থ ইহজাগতিক ধনসম্পদের চেয়ে মূল্যবান। মানুষ নিজেকে ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে বিবেচনা করে। পরোক্ষভাবে মানুষের এই অহংবোধ সমাজের উপকার করে থাকে। ধর্ম মানুষের ইহজাগতিক ব্যর্থতার পরিবর্তে ভালো কাজ করতে উৎসাহিত করে। এভাবে ভালো কাজ করার মাধ্যমে সমাজে ব্যক্তির আপন গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে।

সমাজবিজ্ঞানের সাথে ইতিহাসের সম্পর্ক,পার্থক্য এবং নির্ভরশীলতা

৩। সামাজিক সংহতির অন্যতম সূত্রঃ ধর্ম সামাজিক সংহতির চূড়ান্ত সূত্র। মানবিক মূল্যবোধের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে, এভাবে সমাজের সংহতি বজায় থাকে। সামাজিক  মূল্যবোধের উদ্ভব ধর্ম থেকেই হয়েছে বলে ধরা হয়। ধর্ম হচ্ছে মূল্যবোধের ভিত্তি স্বরূপ। ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের অবাধ্য হবেনা, মিথ্যা কথা বলবেনা, বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করবে, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক আস্থা বজায় থাকবে, মানুষ সৎ ও ধার্মিক হবে এসব মূল্যবোধ সামাজিক সংহতি সংরক্ষণে সহায়ক। ধর্মের সংজ্ঞা 

৪। সমাজকল্যাণঃ ধর্ম মানবতার সেবায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। সামনার ও কেলার পুঁজি সঞ্চয়, অবসরপ্রাপ্ত এবং শিল্পসাহিত্যে নিবেদিত ব্যক্তিবর্গের কর্মসংস্থানকে ধর্মের ভূমিকার অন্তর্ভুক্ত করেন। আদিম সমাজের চিকিৎসকরা যাদুবিদ্যার সাথে যুক্ত ছিল, তাদের মধ্য থেকেই আধুনিক সমাজের বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে। ধর্মগ্রন্থ সমূহ জ্ঞানভাণ্ডার হিসেবে পরিগনিত। ধর্ম সবসময়ই দয়ামায়া এবং পরমতসহিষ্ণুতার উপর গুরুত্বারোপ করে ফলে ধর্মের মাধ্যমে মানুষের মনে সেবার মনোভাব সৃষ্টি করে। এই কারণে দেখা যায় ধনাঢ্য ব্যক্তিরা জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশ্রামাগার, অনাথ আশ্রম ইত্যাদি তৈরী করতে আগ্রহী হয়। ধর্মের সংজ্ঞা 

৫। সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাহনঃ ধর্ম মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। ধর্মে ভালো কাজের জন্য পুরস্কার এবং মন্দ কাজের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। মানুষ ভালো-খারাপ কাজ করার আগে ধর্মীয় দিক চিন্তা করলে সামাজিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। ধর্ম প্রত্যেক সমাজের লোকরীতি, অবশ্য পালনীয় লোকরীতি ও প্রথার অনুমোদন দেয়। এসবের বাস্তবায়নে ধর্মের ভূমিকা রয়েছে। ধর্মীয় প্রভাব সমাজের যুবক-যুবতিদের নৈতিক, শৃঙ্খলাপূর্ণ ও সুনাগরিক হিসেবে জীবন যাপনে আগ্রহী করে।

সমাজবিজ্ঞানে এমিল ডুর্খীম এবং অগাস্ট কোঁৎ এর অবদান (Contributions of August Conte and Emil Durkheim to sociology)

৬। অর্থনৈতিক জীবন নিয়ন্ত্রণঃ ম্যাক্স ওয়েবার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে ধর্মের ভূমিকার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তার মতে প্রোটেস্টেন্ট নীতিবোধ থেকে ইংল্যান্ড আমেরিকা এবং নেদারল্যান্ডসে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছে। কারণ, প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমত পুঁজিবাদে বিশ্বাস করে। অন্যদিকে ক্যাথলিক ধর্মে সুদ, ঘুষকে নিরুৎসাহিত করায় ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের দেশ ইটালি, স্পেনে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেনি। তার মতে উপমহাদেশের ধর্মগুলো বস্তুবাদের বিকাশে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে না পারায় সেখানে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেনি। অবশ্য ম্যাক্স ওয়েবারের উক্ত ধারণা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। ধর্মের সংজ্ঞা 

৭/ সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতাঃ শিল্পসাহিত্য, সঙ্গীতের বিকাশে ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঈশ্বরের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য মানুষ সঙ্গীত, ভাস্কর্য, চিত্রকলা ও স্থাপত্য কাজে নিয়োজিত হয়েছে। বিশ্বের অনেক বড় স্থাপনা ঈশ্বরের মাহাত্ম্য সংরক্ষণের জন্য নির্মিত হয়েছে। ধর্মীয় রচনাবলী মানুষকে সাহিত্যকর্ম সৃষ্টিতে প্রণোদনা যোগায়। এই সাহিত্য কর্ম পড়ে ব্যক্তি প্রভাবিত হতে পারে।

৮। বন্ধুসুলভ কর্মঃ সমাজে বন্ধুত্ব বিকাশে ধর্মের অবদান রয়েছে। ধর্মীয় সভাসমাবেশ মানুষের মিলনকেন্দ্র। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ১৮৯৩ সালে অনুষ্ঠিত শিকাগো বিশ্ব ধর্ম মহাসম্মেলনের কথা। ধর্মের বন্ধুত্বমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে সমাজের ব্যক্তিদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ, সহমর্মিতা, পরমত সহিষ্ণুতা সৃষ্টি হয়।

শিল্পবিপ্লব-উদ্ভব-বিকাশ-সময়কাল

ধর্ম কাকে বলে?

এমিল ডুর্খীম এর মতে, “ধর্ম হলো পবিত্র বস্তু সম্পর্কিত বিশ্বাস ও আচারানুষ্ঠানের একটি একীভূত ব্যবস্থা। আর যার পৃথকীকৃত বস্তুর সাথে রয়েছে বাধা নিষেধের সম্পর্ক।” এডওয়ার্ড সেপির এর মতে,”ধর্ম হচ্ছে আধ্যাত্মিক শান্তি অন্বেষার একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস, যার মাধ্যমে প্রাত্যহিক জীবনের বিপদ-আপদ ও বিফলতা অতিক্রম করা সম্ভব।”

ধর্ম শব্দটির উৎপত্তি হয় কীভাবে? ধর্মের সংজ্ঞা

ধর্ম শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত √ধৃ হতে (সংস্কৃত শব্দ √ধৃ অর্থ ‘ধারণ’)। ধর্মের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Religion’। Religion শব্দটি উৎপত্তি ‘Religere’ থেকে, যার অর্থ যুক্ত বা বন্ধন । Religion শব্দটি এসেছে লাতিন religionem থেকে, যার অর্থ পবিত্র বিষয়ের প্রতি শ্রদ্ধা।

পরিবার কি? এর প্রকারভেদ এবং আধুনিক সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ

ধর্মের উপাদান কতটি?

ধর্মের উপাদান চারটি ।

সমাজবিজ্ঞানীরা ধর্মের ভূমিকাকে কত ভাগে ভাগ করেছেন?

সমাজবিজ্ঞানীরা ধর্মের ভূমিকাকে আট ভাগে ভাগ করেছেন ।

সামাজিকীকরণ কী?

সামাজিকীকরণ হল সমাজে বসবাস করার উপযুক্ত প্রক্রিয়া। বোগারডাস বলেছেন, “সামাজিকীকরণ হচ্ছে একত্রে কাজ করার একটি বিশেষ প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার গোষ্ঠীগত দায়িত্বের প্রকাশ ঘটায় এবং এর মাধ্যমে সে সমাজের মঙ্গল চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়।” অগবার্ন এর মতে, “ব্যক্তি যে প্রক্রিয়ায় গোষ্ঠীর নিয়মকানুন আত্মস্থ করে সেই প্রক্রিয়াকে সামাজিকীকরণ বলে।” সামাজিকীকরণ একটি শিক্ষণ প্রক্রিয়া যা জন্মের পরেই শুরু হয়। এটি এমন এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোন ব্যক্তি মানুষের প্রচলিত নিদর্শনগুলো অর্জন করে। প্রতিটি ব্যক্তি নিজেকে সেই পরিস্থিতি ও পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য করার চেষ্টা করে, যা মূলত সমাজে দ্বারা নির্ধারিত হয়, যার দ্বারা সে একজন সামাজিক জীব বা সদস্যে পরিণত হয়। উপরের সংজ্ঞার আলোকে বলা যায়, সামাজিকীকরণ হচ্ছে একটি শিক্ষণ প্রক্রিয়া, যা শিক্ষার্থীকে তার সামাজিক ভূমিকা যথার্থভাবে পালনে সক্ষম করে।

Reference: 

1) Richard T. Schaefer, Sociology.
২) রংগলাল সেন এবং বিশ্বম্ভর কুমার নাথ, প্রারম্ভিক সমাজ বিজ্ঞান।
৩) হাবিবুর রহমান, সমাজ বিজ্ঞান পরিচিতি।
4) T.B. Bottomore, Sociology. ধর্মের সংজ্ঞা

Leave a Comment

Exit mobile version